আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ
-সুনির্মল বসু
বন্ধুগণ, আপনারা সবাই আমাকে চেনেন, বাসে ট্রামে ট্রেনে অফিস-আদালতে আপনারা সবাই আমাকে দেখেছেন, আমার সবজান্তা ভাব অথবা হাত ছুঁড়ে লম্বা ডায়লগ বাজি শুনে মনে মনে বিরক্ত হলেও, মিষ্টি করে হেসে বোঝাতে চেয়েছেন, বক্তা হিসেবে আমি এডমান্ড বার্কের ভায়রা ভাই, মুখেন
মারিতং জগৎ, কথাটা আমাকে দেখেই চালু হয়েছিল।
বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ, আপনারা আমাকে বিলক্ষণ চেনেন।
আগের আগের শতকে রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ জন্মালেন, আমি তাদের জন্মজয়ন্তী পালন করি, অথচ এদের জীবনের অনেক কিছুই জানিনা, না জেনে বিজ্ঞতার ভান করি। খ্যাতি অর্জন করার দিকে আমার বরাবরের লোভ। আমি যোগ্যতা ছাড়াই যশ প্রত্যাশী। যদি আমরা সত্যিকার রবীন্দ্র চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচরনে, আমাদের কাজ কর্মের মধ্যে তার প্রতিফলন কোথায়, সবার ক্ষেত্রে নয়, অনেকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা লোক দেখানো হয়ে যায় নাকি, আমরা নিজেদের সংস্কৃতিপ্রেমী প্রমাণ করতে গিয়ে,একটা অলীক জীবনের আবহ তৈরি করছি নাকি, বিষয়টি ভেবে দেখার মনে হয় সময় এসেছে।
রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমার পাঞ্জাবীর শিল্পকর্ম দেখে আপনি অবশ্যই বুঝে নেবেন, আমি কতখানি সংস্কৃতিকে স্পর্শ করে আছি।
বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
আমি মানবিকতাকে খালে ফেলে দিয়েছি, বিবেক শব্দটিকে খুন করে আমার হাতে রক্তের দাগ, মূল্যবোধ শব্দটিকে কবে যে নির্বাসনে পাঠিয়ে ছিলাম, আজ আর তা মনে করতে পারি না, কারণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
আমি রবিনসন ক্রুশোর মতো একক দ্বীপে থাকি। আমি থাউজেন্ড পার্সেন্ট স্বার্থপর। আমি কোনো সম্পর্ক মানি না, মুখে আন্তরিকতা দেখাবার অভিনয় করি। যে বিষয়ে আমার স্বার্থ জড়িত আছে, সেখানে আমি ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকি। সর্বক্ষণ ক্ষমতার অলিন্দে আমি ওৎ পেতে বসে আছি। সকলের স্যালুট পাওয়াটা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে।
প্রাচীন সম্পর্কগুলো ব্যাকডেটেড বলেই, আমি সব সম্পর্কের পাট চুকিয়ে দিয়েছি। আমার তুতো ভাইয়েরা চারদিকে বৃদ্ধাশ্রমের রমরমা বানিয়েছে।
আসলে, আমার স্বভাবটা হোল, পাকাল মাছের মতো। আমি এক পুকুরে থাকতে পছন্দ করি না, বারবার নিজের সুবিধামতো পুকুর বদলাই। জগতটা টাকার বশ, এই সার সত্য কথাটা আমি ভালোভাবে বুঝে নিয়েছি। তাই উপরি উপার্জনের দিকে আমার
ঝোঁক বেশি।
বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
আমার পারিপার্শ্বিক মিডিয়াগুলো লক্ষ্য করুন। সেখানে সাংস্কৃতিক গরম মশলা নিয়মিতভাবে পরিবেশিত হয়। নায়িকার বহুবিবাহ থেকে সন্তানের জনক সম্পর্কিত প্রশ্ন, মিডিয়াতে অগ্রাধিকার পায়। অগণিত মানুষের কান্না, জীবন সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, কিংবা মহৎ কর্তব্যবোধের ছবি কখনো অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মতো মিডিয়ার চোখে পড়ে না। টিআরপি বাড়ানোই যেখানে শেষ কথা, সেখানে আদর্শের কথা তোলা, আকাট মূর্খামি।
বন্ধুগণ, আমি ঊনবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। আমাকে আপনারা অবশ্যই চেনেন। স্যুট টাই পরলে ,আমাকে বেশ সফিস্টিকেটেড লাগে। কথা বার্তায় আমি কখনো প্লেটো, কখনো অ্যারিস্টোটল। আমি জগাদার চায়ের দোকানে চারমিনার সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বোদলেয়ার থেকে আলবেয়ার কামু্র সাহিত্য নিয়ে গলা ফাটাই। অথচ, কিছু অনুবাদের বাইরে আমি কিছু পড়ি নি। কারণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
আমার চলাফেরা তেরিয়া ধরনের। আমি প্রথা ভাঙ্গা দুর্বিনীত একালের আঁতেল। যতই লম্ফঝম্প করি না কেন, বিপদ দেখলে, আমি খাটের তলায় আত্মগোপন করি। তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে স্রেফ শীতঘুমে চলে যাই। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বরাবর যা করেন, এই সরল চালাকিটা অনেক কষ্ট করে শিখে নিতে হয়েছে।
বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। এই সমাজে আপনি আমাকে বিভিন্ন রূপে দেখতে পাবেন। ধরুন, আমি একজন চিকিৎসক, পাশাপাশি আমার কবিতা লেখার অভ্যাস। আমার কবিতায় আমি মাইথোলজিক্যাল আঙ্গিকে সামাজিক নানা ঘটনা কাটাছেঁড়া করি। প্রশংসা পাই, হাততালি কুড়াই। কিন্তু নিজের পেশার ক্ষেত্রে
অসহায় রুগীর ব্যাপারে কোনো আর্থিক কনসিডার করিনা।
আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। কর্পোরেট হাউসে বসে শিল্প-সাহিত্যের ঠিকা নিয়ে বসে আছি। এই জায়গাটাকে আমি এমনভাবে কুক্ষিগত করে আছি,
আমার জান পেহেচান পীরিতের লোক ছাড়া, এখানে নো এন্ট্রি’ বোর্ড ঝোলানো আছে। পেয়ার মহব্বতের এই জায়গায় সাধারণের প্রবেশের অধিকার নেই। তাই বস্তাপঁচা সাহিত্য এখন পাবলিককে গিলতে হচ্ছে।
আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ।
সাহিত্য একসময় নিঃসঙ্গ দিন রাতের সারস্বত চর্চা ছিল। এখন কবিতায় আমি নতুন আঙ্গিক এনেছি।
আমার একটি কবিতার নমুনা,
ল্যাম্পোষ্টের মাথায় আর টিভির এন্টেনায় বিচক্ষণ কাগ হেগে যায়। অন্য একটি কবিতায়,
তুমি সাগর আমি ঢেউ, তুমি কুত্তা আমি ঘেউ।
বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। আমার মধ্যে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সভা সমিতিতে আমি এ নিয়ে দু-চার কথা ভাষণ দিয়ে থাকি। কিন্তু আদপে অন্য নারী নয়, নিজের বাড়িতেও আমি নারীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখি না।
অথচ কথায় বলে, চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট হোম।
বন্ধুগণ, আমি একবিংশ শতাব্দীর হামবাগ। একটু লক্ষ্য করে চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, বিভিন্ন পেশায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার মতো হামবাগ সমাজের চারদিকে ছড়িয়ে আছে। গানে নাটকে অভিনয় জগতে, কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসায়, সাহিত্য ক্ষেত্রে ,সর্বত্র এইসব হামবাগদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। এখন সমাজে শ্রোতা কম, বক্তা বেশি।
বন্ধুগণ, আমরা এগোচ্ছি। তবে সামনের দিকে নয়,
ব্যাক গিয়ারে এগোচ্ছি। চলতে জানা যেমন জীবনের অংশ, থামতে জানা তেমনি জীবনের জন্য প্রয়োজন।
করিৎকর্মা আমার মতো হামবাগদের এই কথাটা কে বোঝাবে। সাফল্যের সিঁড়িতে পৌঁছবার এই সহজ রাস্তাটা আমার মতো হামবাগ ছাড়া ,সত্যিই কতজন
জানেন।
( কৃতজ্ঞতা স্বীকার- শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক ঘটক)